হাওজা নিউজ এজেন্সি: ট্রাম্পের এই একপাক্ষিক পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলনকে নিরস্ত্র করার শর্ত, গাজায় বিদেশি প্রশাসন চাপিয়ে দেওয়া এবং ইসরাইলি দখলদারিত্ব বজায় রাখার কৌশল রয়েছে। যা যুদ্ধ থামানোর পরিবর্তে নতুন সংঘাতের বীজ বপন করবে।
উপনিবেশিক ছায়া
এই পরিকল্পনা প্রণয়ন হয়েছে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের অংশগ্রহণে। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এটি পুরোনো ঔপনিবেশিক ধারা অনুসরণ করছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের জাতীয় ও মানবিক অধিকার প্রান্তিক হয়ে পড়ছে—প্রতিরোধকে নিরস্ত্র করা, গাজায় বিদেশি শাসন চাপানো এবং ইসরাইলি নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এর মূল ভিত্তি।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা নতুন কিছু নয়। ১৯১৭ সালের ব্যালফোর ঘোষণা থেকে শুরু করে ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি পর্যন্ত, বিদেশি শক্তি বারবার ফিলিস্তিনি-ইসরাইলি সংকটকে নিজেদের স্বার্থে পরিচালনা করেছে। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে, কারণ ফিলিস্তিনিদের ইচ্ছা উপেক্ষা করে কেবল ইসরাইলি ও পশ্চিমা স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
ট্রাম্পের ২০২০ সালের তথাকথিত “ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি” পরিকল্পনার মতো এই নতুন প্রস্তাবও একই ধাঁচের। হামাসকে নিরস্ত্র করা, গাজায় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক চাপানো, এবং ইসরাইলি সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার মধ্য দিয়েই এটি এগোচ্ছে।
প্রধান চ্যালেঞ্জ
১. প্রতিরোধকে নিরস্ত্র করা
পরিকল্পনার প্রথম শর্ত হলো হামাসকে অবিলম্বে নিরস্ত্র করা ও এর সামরিক কাঠামো ধ্বংস করা। এর সঙ্গে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞার হুমকি।
গাজা সরকারের তথ্য অফিসের মহাপরিচালক ইসমাইল আল-সাওয়াবতা এ বিষয়ে বলেন, “এটি এক নতুন ম্যান্ডেট চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, যা ইসরাইলি দখলকে বৈধতা দেয় এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের জাতীয়, রাজনৈতিক ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।”
অতীত প্রমাণ করে, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ কখনো এই চাপের কাছে নত হয়নি। তাই এটি শান্তি নয়, বরং সংঘাত বাড়াবে।
২. গাজায় বিদেশি প্রশাসন চাপানো
পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, একটি আন্তর্জাতিক “পিস কাউন্সিল” গঠিত হবে—ট্রাম্পের তত্ত্বাবধানে এবং টনি ব্লেয়ারের অংশগ্রহণে। এর অধীনে একটি “প্রযুক্তিবিদ কমিটি” গাজা শাসন করবে।
এটি অতীতের ঔপনিবেশিক মডেলের স্মৃতি জাগায়। টনি ব্লেয়ারের অংশগ্রহণ বিশেষভাবে বিতর্কিত। কারণ ইরাক যুদ্ধকে বৈধতা দেওয়ার ভূমিকায় তিনি আজও সমালোচিত।
ফিলিস্তিনি নেতা মুস্তাফা বারঘুতি বলেন, “আমরা একসময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিলাম। টনি ব্লেয়ারের নাম উচ্চারিত হলে মানুষ প্রথমেই ইরাক যুদ্ধের কথা মনে করে।”
এই বিদেশি শাসন মডেল ফিলিস্তিনিদের নিজেদের ভূমিতে প্রকৃত অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করবে। শান্তির বদলে এটি নতুন ঔপনিবেশিক প্রকল্পে পরিণত হবে।
৩. ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারহীনতা
পরিকল্পনায় ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের কথা থাকলেও কোনো সময়সীমা নেই। ফলে কার্যত উত্তর ও দক্ষিণ গাজায় ইসরাইলি নিয়ন্ত্রণ অটুট থাকবে।
ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক হানি আল-মাসরি বলেন, “সময়সীমাহীন ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের প্রস্তাব মানে হলো, ইসরাইলি দখলদারিত্ব চলতেই থাকবে।”
ফলে ট্রাম্পের দাবি যে “ইসরাইল গাজা দখল করবে না”—তা বাস্তবে ভাঁওতা ছাড়া কিছু নয়।
কেন পরিকল্পনাটি ব্যর্থ?
১. একতরফা ও ইসরাইলপন্থী– হামাস নিরস্ত্র করার ওপর জোর, কিন্তু ইসরাইলি আগ্রাসনের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।
২. মৌলিক অধিকার উপেক্ষা– ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন, এবং পূর্ব জেরুজালেম রাজধানী করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা নেই।
৩. বাস্তবায়নে অচলাবস্থা– প্রতিরোধ নিরস্ত্র হবে না, আরব দেশগুলোও এ পরিকল্পনার বিরোধী।
৪. অতীতের পুনরাবৃত্তি– ইরাক দখলের পর বিদেশি শাসনের মতোই এটি ব্যর্থতার দিকে যাবে।
ট্রাম্পের ২০ দফা গাজা পরিকল্পনা একতরফা ও অস্পষ্ট। এতে ইসরাইলি বন্দিদের মুক্তি, হামাস নিরস্ত্রকরণ, মৃতদেহ হস্তান্তরের মতো শর্ত রয়েছে—কিন্তু গাজা পুনর্গঠন, মানবিক সাহায্য বা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে কিছু নেই।
বিদেশি প্রশাসন চাপিয়ে দেওয়া ও ইসরাইলি সেনাদের ধাপে ধাপে প্রত্যাহার আসলে দখলদারিত্বের নতুন রূপ। হামাসকে সরিয়ে দিয়ে পরিকল্পিত “নিরাপদ পথ” দেওয়াও দখল চাপিয়ে দেওয়া ছাড়া কিছু নয়।
মিসরের সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ এলবারাদেই এ পরিকল্পনাকে বলেছেন, “এটি আত্মসমর্পণ ও আপসের পরিকল্পনা।”
সত্যিকার শান্তির জন্য দখলদারিত্বের অবসান এবং ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
ইরানভিউ২৪-এর কৌশলগত বিশ্লেষণ
ট্রাম্পের পরিকল্পনার তিনটি মূল বিষয় হলো:
১. প্রতিরোধকে নিরস্ত্র করা
২. বিদেশি প্রশাসন চাপানো
৩. ইসরাইলি নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা
এগুলো আসলে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করে অতীতের উপনিবেশিক কাঠামো পুনর্গঠন।
- ভূরাজনীতি: পরিকল্পনাটি ইসরাইলের স্বার্থে সাজানো, আঞ্চলিক নিরাপত্তায় প্রতিরোধ শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করতে চায়।
- সামাজিক দিক: এটি জনগণের সমর্থনহীন, কারণ ফিলিস্তিনিদের মৌলিক দাবি উপেক্ষিত।
- আঞ্চলিক দিক: আরব দেশগুলোর বিরোধিতা ও আমেরিকা ও ব্লেয়ারের প্রতি গভীর অবিশ্বাস এর বাস্তবায়ন অসম্ভব করে তুলবে।
অতীতের অভিজ্ঞতা—ব্যালফোর ঘোষণা থেকে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি—প্রমাণ করে: প্রতিরোধ ধ্বংস, জাতীয় অধিকার অস্বীকার এবং বিদেশি ম্যান্ডেট চাপিয়ে দেওয়া কোনো পরিকল্পনা কখনোই শান্তি আনেনি। বরং নতুন সংঘাত ও প্রতিরোধকে উসকে দিয়েছে।
অতএব, ট্রাম্পের ২০ দফা গাজা পরিকল্পনা শান্তির রোডম্যাপ নয়; এটি একটি ব্যর্থ ভূরাজনৈতিক প্রকল্প, যা নতুন সংঘাত ও প্রতিরোধের চক্র শুরু করবে।
আপনার কমেন্ট